নগর/আরবান স্বাস্থ্যসেবা (City/ Urban Healthcare)
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ দ্রুত নগরায়নের দিকে যাচ্ছে। শহরের জনসংখ্যার অনুপাত থেকে প্রতীয়মান হয় যে ২০১১, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে নগরায়ণ যথাক্রমে ৩১%, ৩৩% ও ৩৪% ছিল। এই হারে ২০৫০ সাল নাগাদ নগর জনসংখ্যা ৫৬% পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
নগরাঞ্চলের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক স্বাস্থ্যসেবা সাধারণত তিন ধরনের স্বাস্থ্য সেবাপ্রদানকারীর মাধ্যমে দেয়া হয়ে থাকে-
(ক) সরকারি,
(খ) বেসরকারি (দাতা সংস্থার সহায়তাপুষ্ট) এবং
(গ) প্রাইভেট স্বাস্থ্য সেবাপ্রদানকারী।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সরকারি পর্যায়ের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে।
সারাদেশে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যাপক নেটওয়ার্ক রয়েছে। বর্তমানে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে নগর/মহানগর পর্যায়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, যক্ষ্মা হাসপাতাল ও কুষ্ঠরোগ হাসপাতাল রয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই সকল সরকারি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র নগরাঞ্চল, উপ-নগরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টার্শিয়ারি পর্যায়ের এবং বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। এর বাইরে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নগরবাসীদের ইপিআই, মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক বহির্বিভাগ সেবা দিচ্ছে। এছাড়াও, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে জেলা সদরে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে।
মা ও শিশুস্বাস্থ্য এবং জেলা সদর হাসপাতালসমূহ প্রসবকালীন সেবা, প্রসবোত্তর সেবা, গর্ভপাত পরবর্তী সেবা, তাৎক্ষণিক নবজাতকের যত্ন, পাঁচ বছরের নিচে শিশুর চিকিৎসা, নবজাতকের সংক্রমন ব্যবস্থাপনা, জন্মকালীন শ্বাসকষ্ট ব্যবস্থাপনা, সংক্রামক রোগের ব্যবস্থাপনা, অসংক্রামক রোগের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিসহ প্রতিকারমূলক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকে। এই হাসপাতালসমূহ গর্ভকালীন সেবা, প্রসবোত্তর সেবা, টিকাদান, নবজাতকের অত্যাবশ্যকীয় যত্ন, কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যশিক্ষা, পুষ্টির ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ/ ব্যবস্থাপনা, দশ বছরের নিচে শিশুদের কৃমিনাশক প্রদান ইত্যাদিসহ সকল প্রকার প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবাও প্রদান করে থাকে। উপজেলা হাসপাতালসমূহ একইরকম প্রতিকারমূলক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকে; যদিও কিছু কিছু প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা সেখানে পাওয়া যায় না।
বিশেষায়িত হাসপাতালসমূহ সুনির্দিষ্ট বিষয়ে সেবা প্রদান করে (যেমন- হৃদরোগ, চোখের সমস্যা, কিডনী রোগ ইত্যাদি) । মা ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটসমূহ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাতৃ, শিশু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ইউনিটসমূহ সকল প্রকার পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সেবা প্রদান করে থাকে। এই হাসপাতালসমূহ টিকাদান ও পাঁচ বছরের নিচে শিশুর চিকিৎসাও দিয়ে থাকে। মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সেবা প্রদান করে ।
সিটি কর্পোরেশন এলাকায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে ডিসপেন্সারী পরিচালনা করে থাকে যেগুলো বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা প্রদান করে। নগরাঞ্চলে টিকাদান ও পরিবার পরিকল্পনা সেবার সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্য (টিকা ও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিসমূহ) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বেসরকারি সংস্থাসমূহের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন বন্টন করে থাকে।
স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টরের নীতিমালা তৈরি ও পূণর্গঠনের পদক্ষেপ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়ে থাকে। এছাড়া সেবার নীতিমালা প্রনয়ণ, চিকিৎসা শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণ, ওষুধ তৈরি ও ব্যবস্থাপনার গুণগত মান মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহ নিয়ন্ত্রণ এবং পেশাজীবীদের প্র্যাকটিস নিয়ন্ত্রণসহ নগর ও গ্রামাঞ্চলের সকল নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কাজের দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপর ন্যাস্ত। বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এই দায়িত্বসমূহ পালন করে।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এবং স্থানীয় সরকার (মিউনিসিপ্যালিটি) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, নগরবাসীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রদানের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটির। হাসপাতাল ও ডিসপেন্সারির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সিটি কর্পোরেশনে এসকল সেবা দিয়ে থাকে। এছাড়াও, আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিস ডেলিভারি প্রজেক্ট-এর অধীনে ১১টি সিটি কর্পোরেশন ও ৫টি মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় ১৬১টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র, ২৪টি সমন্বিত প্রজনন স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র, ৬৪৪টি স্যাটেলাইট ক্লিনিক, ২৪টি ভলান্টারি কাউন্সেলিং ও চিকিৎসাকেন্দ্র, ৯২টি প্রত্যক্ষ চিকিৎসাকেন্দ্র এবং ২৪টি প্রাথমিক চক্ষুসেবা কেন্দ্রসমূহের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় সেবা দেয়া হচ্ছে। এগুলোর পাশাপাশি নগর এলাকায় বেসরকারি সংস্থাসমূহের বাস্তবায়নে ও দ্বাতা সংস্থার অর্থায়নে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আরো কিছু কর্মসূচি চলছে। আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট, দি স্মাইলিং সান ফ্র্যানচাইজ প্রোগ্রাম, নগর বস্তিতে ব্র্যাক মানসী প্রোগ্রাম এবং বেসরকারি সংস্থার সেবাকেন্দ্রভিত্তিক ও কমিউনিটিভিত্তিক কর্মসূচি যেগুলো বর্তমানে নগর স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে, যেমন-মেরী স্টোপস ক্লিনিক। প্রাইভেট সেক্টরও এখানে গ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার, ফার্মেসী ও প্রাইভেট ক্লিনিকের মাধ্যমে নগরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অন্যান্য প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মধ্যে রয়েছে প্রাইভেট হাসপাতাল, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং অনেক প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার। বস্তিবাসী প্রথমে স্বাস্থ্যসেবা নেয় ওষুধের দোকান থেকে; তারপর তারা যায় প্রাইভেট হাসপাতাল/ক্লিনিকে।
Comments
Post a Comment